সবুজ রঙে রাঙিয়েছে প্রাকৃতি মিলন মেলা টাংগুয়ার হাওরে
ঋতুরাজ বসন্তের এখন প্রায় মাঝামাঝি। চৈত্রের মাত্র কিছুদিন দিন বাকি। গ্রাম বাংলার প্রকৃতি সবুজে রঙে নতুন পাতা গজিয়ে রাঙিয়েছে তার আপনমনে।
এর মাঝে কোকিলের কুহ কহ কলধ্বনি,সেই সাথে বিলুপ্তপ্রায় গুইজ্যাকাটা ,বড়ুন,সহ বিভিন্ন গাছের ফুল দেখে বোঝা যায় চলছে ফাগুন। আর শীত ভেঙে মৃদু উষ্ণতা জানান দেয় ফাগুনে প্রকৃতিতে লেগেছে আগুন।
সময়ের আবর্তে পড়ে দিনের পর দিন মাসের পর মাস পেরিয়ে বছরের শেষে আসে এই ঋতুরাজ বসন্ত। আর এই বসন্তে সৌন্দর্যের লীলা ভূমি টাংগুয়ার হাওরের প্রকৃতি ফুলে ফুলে সবুজাভ পাতায় পাতায় ভরিয়ে কোকিলের কুহ কহ কলতানে মুখরিত হয়ে, টাংগুয়ার হাওরে আগত প্রকৃতিপ্রেমী ভ্রমণপিয়াসীদের বরণ করে নেয়।
এই ঋতুরাজ বসন্তের ছোঁয়ায় শীতের খোলস ছেড়ে ফুল ও সবুজ পাতায় পাতায় ভরে উঠে এই হাওরের বৃক্ষরাজি,হিজল, করচ,বরুণ, গুইজ্যাকাটা, বনতুলসী, সহ সবুজ রঙে রঙিন হয়ে ওঠে টাংগুয়ার হাওর পারের গ্রামের পর গ্রাম বন-বাদার বিভিন্ন বাগবাগিচা।
ঋতু চক্রে বসন্তে প্রকৃতিপ্রেমীদের জীবনে এক অন্যরকম অনুভূতি জন্মায়, বিশেষ করে এই সময় বসন্তের ডাকে প্রকৃতি তার পুরনো সব ঝড়ে পেলে নতুন রূপে সজ্জিত হয়। বসন্তে প্রকৃতির এই রূপসাগরে প্রকৃতিপ্রেমীদের মিলনমেলায় পরিণত হয় টাংগুয়ার হাওর।
প্রকৃতিপ্রেমীদের মনটানে প্রকৃতির কাছে তার সৌন্দর্যকে আপনকরে নিতে মন চঞ্চল হয়ে উঠে।বসন্তে গ্রামবাংলার প্রকৃতি ও জীবনে মনভোলানো রুপ মিশে থাকে ভালবাসা,কোকিলের কুহ কুহ ডাক বাহারি রঙের ফুলের মনভুলানো গন্ধ কতনা উৎসব। যে কারণে শহরের বাবুরা যান্ত্রিক শহরের ক্লান্তি জীবনের সুযোগ পেলেই ছুটে আসে গ্রামের পানে।
চিরায়ত সুজলা সফলা শস্যশ্যামলা অপরুপ এই টাংগুয়ার হাওর শীতকালের ঝড়া পাতা,গাছে গাছে নতুন পল্লবে সজ্জিত হয়। শীতের পাতাঝড়ানোর দিনগুলো পেছনে ফেলে ফাল্গুন মাস প্রকৃতির জীবনে নিয়ে আসে নানা রঙের ছোঁয়া।ঘনকুয়াশার চাদর সরিয়ে প্রকৃতিকে নতুনভাবে সাজাতে,বাতাসে বাতাসে ফুলের সুবাস ছড়িয়ে দিতে ফাল্গুন আসে নতুনভাবে নতুন রূপে।
নতুন প্রাণের উদ্যমতা প্রকৃতির সৌন্দর্যের অনুপ্রেরণা যোগান দেয় আমাদের টাংগুয়ার হাওরের অন্যতম বড় হিজল করচের বাগান। ধুলোপড়া নাগরিক চোখকে আরাম দিতে বছর বছর দাঁড়িয়ে আছে,হাওরে চারিপাশে সারি সারি প্রকৃতির এই অপরুপ সৌন্দর্য। ভ্রমণপিয়াসী প্রকৃতিপ্রেমীরা যে যার চাহিদামত কেউবা আসেন শীতে কেউবা আবার বসন্তে কেউবা আবার বর্ষায়ও।
টাংগুয়ার হাওর সুন্দরবনের পর দেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট। স্থানীয়দের ভাষায় নয় কুড়ি কান্দার ছায় কুড়ি বিল খ্যাত এই হাওরের জঙ্গল কান্দায় লক্ষ লক্ষ হিজল করচের মেলা। সুনামগঞ্জ তাহিরপুর উপজেলার সুলেমানপুর থেকে জয়পুর গোলাবাড়ি হয়ে ধর্মপাশা উপজেলার রংচি গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে হিজল করচের বাগ।
বসন্তে সবুজাভ পাতায় পাতায় কি এক অপরুপ সৌন্দর্যে সেজেছে এই হিজল করচের বাগ। এই সময় কোকিল,শালিক সহ নানা প্রজাতির পাখির অস্থায়ী আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে এই গাছগুলো। কোকিল ও শালিকের ডাক কি এক মধুর কন্ঠ।
বর্ষায় এই হিজল করচের গাছগাছালি হাওরের জলে ছায়া ফেলে মায়া লাগায়,হিজল করচের বাগ হাওরের আফাল থেকে হাওর পারের বসবাসরত জনগোষ্ঠীর জীবন ও সম্পদ রক্ষার দেয়াল হিসেবেও কাজ করে। ভরা বর্ষার উত্তাল হাওরে যখন ঢেউয়ের গর্জন ওঠে তখন এই হিজলের গাছে নৌকা বাঁধে হাওর পারের মৎস্যজীবীরা ঢেউয়ের ঝাপটা সামলায়।
টাংগুয়ার হাওরে আশির দশকে জয়নাল আবেদিন নামের এক বৃক্ষপ্রেমী ইজারাদার ছিলেন উনি সরকারের সাথে চুক্তি করে প্রায় এক লক্ষাধিক করচের চারা রোপণ করেছিলেন হাওরের চতুর্পাশে । এছাড়াও টাংগুয়ার হাওর বিভিন্ন মেয়াদে প্রকল্পের মাধ্যমেও হিজল করচের চারা রোপণ করা হয়েছে।
এই চারা গুলোই এখন বসন্তের ডাকে আপনমনে ভীষণ সৌন্দর্যের রূপধারণ করেছে।বাদবাকি বিভিন্ন কান্দায় প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া কিছু হিজল করচ ও জঙ্গলের সৃষ্টি হয়েছে। টাংগুয়ার হাওরের কথিত নয় কুড়ি কান্দার ছয় কুড়ি বিল জুড়েই বসন্ত এলেই হাওরের বিভিন্ন করচের বাগানে সবুজ হাতছানি দেখতে পাওয়া যায়।
আবার বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে হিজলের ফুল ফোটে হালকা গোলাপি রঙের ফুল গাছের লম্বাটে ডাঁটায় সারিসারি মালার মতো থাকে।এই হিজল করচের বাগ মাছের নিরাপদ অভয়াশ্রম হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হিজল করচের পাতা মাছের জন্য খুবি পছন্দ শীল,অতিথি পাখির পরেই টাংগুয়ার হাওরের অন্যতম আকর্ষণ হিজল করছের বাগান।
বিশেষজ্ঞদের মতে হিজলগাছের রয়েছে অনেক ঔষুধি গুণও।তবে টাংগুয়ার হাওরের প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে নেই কোন লক্ষণীয় উদ্যোগ, হচ্ছে না পর্যাপ্ত পরিমাণ গাছ লাগানোর কোন বাস্তবমুখী পরিকল্পনা । ফলে দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে টাংগুয়ার হাওরের হিজল করচের গাছগাছালি।
সবমিলিয়ে গ্রামবাংলার প্রকৃতির এই রূপের সুধা পান করতে,প্রকৃতির টানে অনেক কর্মব্যস্ততার ফাঁকে যান্ত্রিক শহরের কলকারখানা আর বিশাক্ত ধোঁয়া ছেড়ে সবুজ ঘেরা প্রকৃতির কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে কিছু সুখ পেতে,বর্তমান প্রজন্মকে গ্রামীণ পরিবেশে কেমন তা জানতে প্রকৃতিপ্রেমীরা এভাবেই ছুটে আসেন সবুজাভ প্রকৃতিঘেরা হাওরে। এবং এই চিরায়িত গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক রূপ বৈচিত্র্য উপভোগ করে অনেকেই ধন্য।
তাহিরপুর প্রতিনিধি(সুনামগঞ্জ)
দৈনিক ভোরের বার্তা
About Author
Leave a reply
You must be logged in to post a comment.
কবিতা: অনুতপ্ত হতে হবে