ঐতিহ্যবাহী ‘তৃপ্তি হোটেলর শাটার লাগানো হলো ৪৮ বছর পর

তৃপ্তি হোটেল। নামের সঙ্গে এর কাজের ও ব্যাপক মিল। এই তৃপ্তি হোটেল এ এসে খেয়ে কেউ তৃপ্তি পাননি এমন মানুষ খুজে পাওয়া মুশকিল। হ্যা বলছি পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার অন্যতম খাবার হোটেল ‘তৃপ্তি হোটেল’ এর কথা। যে হোটেল এ কিনা প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছরেও ছিলনা কোন শাটার বা দরজা।
কিন্তু সেই ঐতিহ্য আর রাখা গেল না, এবার সেই হোটেল এ শাটার লাগানো হোল।
দেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক নেতা, সরকারি আমলা, এমপি, মন্ত্রী, পদস্থ কর্মকর্তাদের পদচারণা রয়েছে এই তৃপ্তি হোটেলে। বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে ‘দরজাবিহীন’ এই হোটেল নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রচারসহ একাধিক জাতীয় সংবাদপত্রেও এই হোটেলকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে।
বিবিসি বাংলায় এই হোটেল নিয়ে নিউজ প্রকাশ হয়েছে। এমনকি ভারতের বিখ্যাত ক্রিকেটার সৌরভ গাঙ্গুলী দাদাগিরিতে প্রশ্ন করেছিলেন বাংলাদেশের কোন জেলার কোন উপজেলায় দড়জাবিহীন হোটেল রয়েছে। রাশিয়া, চীন, ভারত, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের অসংখ্য নাগরিকরা এই হোটেলের খাবার খেয়ে প্রশংসা করেছেন।
স্থানীয়রা বলেন, হোটেলটি ঈশ্বরদী জংশনের পাশে হওয়ায় সকাল-বিকেল কিংবা সন্ধ্যায় বেড়াতে এসে প্রতিদিন একবার হলেও তৃপ্তি হোটেলে নাস্তা করে আমরা মনের তৃপ্তি পূরণ করি। এই হোটেলের বিশেষত্ব হলো গরুর ভাজা মাংস। এটা খুবই মজাদার।
স্থানীয় এক ব্যবসায়ী জানান, হোটেলের পাশেই আমার ব্যাগের দোকান। প্রতিদিনই আমি এখানে খাবার খেতে আসি। মানসম্মত খাবার ও হোটেলের পরিবেশ ভালো হওয়ায় ঈশ্বরদীবাসীর কাছে প্রিয় তৃপ্তি হোটেল।
হোটেলে কর্মরত আব্দুল খালেক বলেন, আমি এখন কোনো কাজ করতে পারি না। কাজে অক্ষম, অনেকটাই প্যারালাইসিসের মত হয়ে আছি। তবুও হোটেল মালিক আমাকে রেখে দিয়েছেন। বেতন-ভাতাসহ নানা সুবিধাও পাই। এখান থেকে কোনো কর্মচারী চাকরিচ্যুত হয় না।
তিনি আরও বলেন, ৩৭ বছর ধরে দেখছি সব পেশার মানুষ এখানে খাবার খেতে আসে। শহরে যত রাজনৈতিক-সামাজিক সভা হয়, সেখানে আগত অতিথিদের আপ্যায়ন করানোর প্রধান জায়গা এই তৃপ্তি হোটেল।
হোটেলের ম্যানেজার বিপ্লব কুমার জানান, ১৯৮৯ সালে শৈশবকালে এই হোটেলে কাজে আসি। দীর্ঘ বছর দেখেছি এপার বাংলা ওপার বাংলার কবি সাহিত্যিকদের পদচারণায় মুখরিত ছিল এই হোটেল। হোটেলের সামনে বিশাল রেডিও লাগানো ছিল।
এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ বিবিসির খবর শোনার জন্য এখানে ভিড় করতো। প্রয়াত সাংবাদিক কামাল লোহানী, প্রয়াত সাবেক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুসহ দেশের কবি-সাহিত্যিকদের মিলনমেলায় পরিণত হতো এই হোটেল। বিকেল থেকে সন্ধ্যা এমনকি গভীর রাত পর্যন্ত চলতো আড্ডা।
জানা গেছে, ১৯৭২ সালে হোটেলটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই দিন-রাত সমানে চলেছে। এক দিনের জন্যও হোটেলটি কেউ বন্ধ পায়নি। হোটেলটি মূলত রেলওয়ের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। জায়গাটির লিজ গ্রহীতা আবদুর রহিম। এখনও হোটেলের সাইনবোর্ডে তার নাম লেখা। পরবর্তী সময়ে আবদুর রহিম ঘরটি ভাড়া দেন স্থানীয় ডোমনাকে। এখন বংশ পরম্পরায় এই হোটেলের বর্তমান সব দায়িত্ব ও পরিচালক আব্দুল মালেক মানিক।
বর্তমান হোটেলটিতে ২০ জন কর্মচারী ও দুইজন ম্যানেজারসহ প্রায় ২৫ জন কর্মচারী নিয়োজিত আছেন। আগে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকলেও বর্তমান করোনাভাইরাসের কারণে হোটেলটি ভোর ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ১৬ ঘণ্টা খোলা থাকে।
হোটেলের বর্তমান পরিচালক আব্দুল মালেক মানিক জানান, প্রয়াত আবদুর রহিমের পর হুমায়ুন কবির ও মহব্বত আলী এই হোটেলটির হাল ধরেন। এর পর মহব্বত আলীর ছোট ভাই ইদ্রিস আলী হোটেলটি পরিচালনার দায়িত্ব পান। আর হোটেল পরিচালনায় ছিলেন তার ছোট ভাই আমজাদ হোসেন ডোমনা। বংশ পরম্পরায় বর্তমানে হোটেলটি পরিচালনা করেন ইদ্রিস আলীর দুই ছেলে আব্দুল মান্নান ও আব্দুল মালেক মানিক।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের শুরুতে যখন প্রশাসন হোটেলটি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় তখন বন্ধ হোটেলটিতে স্থানীয় বখাটের দল রাতভর আড্ডা দিয়ে স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করে দিচ্ছিল। তাই বাধ্য হয়ে হোটেলটি রক্ষা করার স্বার্থে প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছর পর শাটার লাগাতে বাধ্য হই। শাটার লাগানোর মধ্য দিয়ে ঐতিহ্যময় এই হোটেলটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গেল।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, দরজাবিহীন হোটেলটির ঐতিহ্য আর ধরে রাখা গেল না। এখন থেকে আর বলার সুযোগ রইল না যে এই হোটেলের দরজা নেই।
বিশেষ প্রতিনিধি, পাবনা।